মন পাথরে হঠাৎ ঝড় সিজন ২ পর্ব ১৫
Tahrim Muntahana
সাঁঝের বেলার শেষভাগ। সূর্যটা পরম আবেশে মিলিয়ে গেছে আকাশে। তার পিছু পিছু চাঁদ নিজের আলো দিতে জেগে উঠেছে পূর্ণ ভাবে। আকাশের বুকে মস্ত বড় চাঁদ টা আলো দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে আজ ভরা পূর্ণিমা। সবকিছু যেন দিনের মতোই ফকফকা। এই পূর্ণিমা রাতে নানা রকম আলোক সজ্জায় সেজে উঠেছে রিসোর্ট টি। প্রত্যেকটা মানুষ চোখ ধাঁধানো সাজসজ্জার সাথে তাল মিলিয়ে নিজেদেরকে ও সাজিয়ে তুলেছে অপরূপে।
কেউ কেউ ব্যস্ত পায়ে ছুটোছুটি করছে কাজের জন্য, কেউ কেউ হাত চালিয়ে কাজ করছে, কেউ কেউ আড্ডা দিতে ব্যস্ত, কেউ কেউ ছবি তুলতে ব্যস্ত, কেউ কেউ সাজতে ব্যস্ত, আবার কেউ কেউ অধির আগ্রহে অপেক্ষা করতে ব্যস্ত। সবাই কোনো না কোনো কাজে ব্যস্ত। আহা কি অপূর্ব পরিবেশ।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
আতইয়াব-মৃহান কে একটু আগেই আনা হয়েছে। বর্তমানে তারা সোফায় গা এলিয়ে বসে আছে। নতুন বর হিসেবে না আছে লাজুকতা না আছে অস্থিরতা শুধু ফুটে উঠছে অপেক্ষা! দুজনেই বার বার সিঁড়ির দিকে তাকাচ্ছে; কখন আসবে প্রেয়সী? কখন নয়নযোগল মুগ্ধ হবে? তৃষ্ণার্ত এই বুকটা কখন শান্ত হবে? একরাশ আবেগ-আশা-মুগ্ধতা-ভালোবাসা নিয়ে অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে দুজন প্রেমিক পুরুষ।
একটু পরেই যারা হবে অর্ধাঙ্গ! পবিত্র তিন শব্দ উচ্চারণ করে জীবনের ভাগীদার হয়ে যাবে। হালাল এক সম্পর্ক সৃষ্টি করবে। বউ এসেছে বউ এসেছে কথাটা শুনেই দুজন চমকে উঠে। আপন মনে ভাবছিলো; দুজনের মুখেই হাসি ফুটে উঠে। প্যান্ডেল থেকে নেমে সিঁড়ির দিকে এগোবে তার আগেই কয়েক জন ছেলে মেয়ে কে নিয়ে হইহই করে নিচে নামে হৃদান।
মূলত হৃদানের কথায় তারাই বউ আসার মিথ্যা সংবাদ দিয়েছে। হৃদান জনসমক্ষেই হো হো করে হেসে দেয়। দুজন কে বোকা বানাতে পেরে যেন দারুণ মজা পেয়েছে। আতইয়াব-মৃহান তো কটমট চোখে তাকিয়ে আছে। পারে না গিলে খায় হৃদানকে। হৃদান হাসতে হাসতেই বলে উঠে,
কেমন দিলাম মি. ডক্টর! ইশশশ মুখটা দেখার মতো হয়েছে। আহা শান্তি!
আতইয়াব তেড়ে আসতে চেয়েও মৃহানের হাত ধরায় আসতে পারলো না। হৃদান এতে যেন আরো বেশী আনন্দ পেলো। সে ইচ্ছে করেই কনেদের দেরীতে আনতে বলেছে। সে ভালো করেই জানে এই লোক কবুল বলার পর আর তাকে দাম দিবে না; সাপের পাঁচ পা দেখবে। নানা কৌশলে তার প্রেমে ব্যাঘাত ঘটাবে। তাই তো সে একটু জ্বালিয়ে নিচ্ছে। আতইয়াব দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠে,
ভাইয়া ছাড়ো আমাকে। এর এক পা ভাঙা আরেক পা ও আমি ভাঙবো। ব্যাটা আস্তো এক হারামি।
এবার মৃহানের ও হাসি পেলো। ফিক করে হেসে দিতেই আতইয়াব আকাশ সমান রাগ নিয়ে সোফায় বসে রইলো। ওরা তিনজন নিজেদের মধ্যে এতই ব্যস্ত যে সবাই যে হৃদান কে হা করে দেখছে কারোর ই খেয়াল নেই। হৃদান হাসা থামিয়ে চারদিক তাকাতেই ভ্রু কুঁচকে আসে তার।
এমন করে দেখছে কেন সবাই? হঠাৎ মুখে হাত দিয়ে যখন দেখতে পেলো মুখে মাস্ক নেই আপনাআপনি হৃদানের মাথায় হাত চলে গেল। আজ তাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। একটু সময়ের মধ্যেই ভিড় জমে গেল। জনপ্রিয় মডেল হৃদান চৌধুরী এসেছে। সেলফি অটোগ্রাফ নিতে চলে এসেছে; হৃদান না পারছে সইতে না পারছে কিছু বলতে। হৃদানের অবস্থা দেখে পান্চু আর দূরে গেল না সাথে সাথে থাকলো। আর আতইয়াব তো হেসেই খু* ন হয়ে যাবে মনে হচ্ছে।
মাথায় শয়তানি বুদ্ধি খেলতেই বাঁকা হাসলো। এবার দেখ মজা কাকে বলে! পকেট থেকে ফোন বের করে আদর কে একটা ম্যাসেজ পাঠালো। রেডি হয়ে বসে ছিলো আদর। হৃদযার সাজ কমপ্লিট কিন্তু সুবাহ এত সেজেছে তবুও নাকি তার সাজ এখনো শেষ হয়নি। তার কথা বিয়ে সে একবারই করবে, সাজবে না কেন! আতইয়াবের ম্যাসেজ পেয়ে আদর বেরিয়ে আসলো ঘর থেকে। কি এমন দরকার পড়লো এত জরুরি ডাকছে।
কোনো সমস্যা হলো না তো! ভেবেই আদরের বুকটা ধক করে উঠলো। কিছুদিন ধরে যা ঘটছে ভাবা অস্বাভাবিক নয়। আদরের গায়ে লাল টকটকে লেহেঙ্গা, ম্যাচিং জুয়েলারির সাথে মাথায় সাদা গোলাপ; যে কেউ ই এই রূপ থেকে বারবার তাকাতে বাধ্য হবে। আদর দুই হাত দিয়ে লেহেঙ্গা টা উঁচু করে ছুটতে শুরু করলো। নুপুরের ঝংকারের তালে অপরূপা এক মেয়েকে দৌড়াতে দেখে শুধু ছেলেরা কেন মেয়েরাও তাকিয়ে আছে। রূপ যেন ঠিকরে পড়ছে। আহা সৌন্দর্য!
সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠছিলো আতিক। মা ঘটা করে ডেকেছে। খানিক টা বিরক্ত সে। তার মা তাকে কেন ডেকেছে সে জানে। গেলেই একগাদা উপদেশ দিবে আদরের সাথে সাথে থাকতে, আদরের প্রতি যত্নশীলতা দেখাতে, কথা দ্বারা নিজের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করতে! কিন্তু তার মা কি জানে; আদর নামক মেয়েটিকে যে সে ছেলের বউ করতে উঠেপড়ে লেগেছে সে মেয়ে তাকে পাত্তায় দেয় না।
ভাবনার মাঝেই করিডরে চোখ পড়তেই আতিকের মুখ হা হয়ে যায়। এটা মানুষ না কোনো পরী! আতিকের কাছে তাই মনে হচ্ছে। নাহ এই মেয়েটাকে হাত ছাড়া করা যাবে না। যেভাবেই হোক নিজের করেই ছাড়বে। সাথে মা তো আছেই টেনশন কিসের! আদর সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যায় একবারো আতিকের দিকে তাকানোর প্রয়োজন মনে করে না। এতে অবশ্য আতিকের খানিকটা খারাপ লাগে। কেন? একটু তাকালে কি হতো?
একটু মিষ্টি করে হাসলে কি হতো? সে হাসিতে হারিয়ে যেত। মাথা চুলকে হাসে আতিক। কি সব ভাবছে সে। ভাবনা গুলো সাথে নিয়েই মায়ের সাথে দেখা করতে চলে যায়।
হৃদান যেন দিশেহারা। গার্ড কে বলতেও পারছে না সবাইকে সরাতে। তাকে ভালোবেসেই সবাই এসেছে। আবার নিজের মাঝেও হাঁসফাঁস লাগছে। কেমন অস্থির করছে যার দরুণ হালকা ঘামছে সে।
পান্চু নিজেও অপারগ! এতদিন পাশে থাকায় সে স্যারের মুখ দেখেই স্যারের মনের অবস্থা সম্পর্কে বুঝেছে। স্যার ই দোষী এতে। আতইয়াব কে জব্দ করার খুশিতে মাস্ক পড়ে আসতেই ভুলে গেছে সে। তার উপর উপরি জুটেছে পিয়ানি। হৃদান কে দেখেই সে গা ঘেঁষার জন্য ছটফট করছে।
আর কাউকেই তেমন আসতে দিচ্ছে না। এতে অনেকেই অনেক কিছু মনে করছে। পিয়ানির যেন খুশি ধরেই না। এতদিন যাকে নেটে দেখে এসেছে তাকে সামনাসামনি দেখছে; খুশি হওয়ার ই কথা। এত লোকের মাঝে হৃদান নিজেও বুঝতে পারেনি ব্যাপার টা। সে অসুস্থ বোধ করছে। খুব করে আদরের অভাব বোধ করছে সে। চোখ ঘুরিয়েও লাভ হয়নি; আদর নেই কোথাও।
অন্যদিকে আদর কে নিচে আসতে দেখেই আতইয়াব কিটকিটিয়ে হেসে উঠে। তাকে আর কিছু করতে হবে না; আদর নিজেই করে দিবে। হৃদানের পাশে এত গুলো মেয়ে দেখে আদরের চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম। মাথায় ধপ করে আগুন জ্বলে উঠে যেন। আরেকটু সামনে এগোতেই হৃদানের অসহায় মুখটা দেখে নিভে যায় সে।
বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করে। মন বলছে লোকটা তাকেই খুঁজছে। পিয়ানি কে হৃদানের এত কাছে দেখে আদর থেমে যায়। কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। বিয়ে বাড়ি এটা ভুলে গেলে চলবে না। তার একটা ভুল পদক্ষেপে হৃদানের মডেলিং ক্যারিয়ার টাও শেষ হয়ে যেতে পারে। সে তো জানে হৃদান চৌধুরী নামক লোকটা তাকে নিজের থেকেও বেশী ভালোবাসে। জোরে জোরে দম নিয়ে মুখটাকে গম্ভীর করে এগিয়ে যায়;
কি হচ্ছে এখানে?
চমকে উঠে গাম্ভীর্য গলায় কথা টা শুনে। হৃদানের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে। এই গলার আওয়াজের মালিকটা তার একান্তই নিজের। আদরের কথায় কিছু কিছু মানুষ পিছিয়ে যায়। হৃদানের চোখ আদরের উপর পড়তেই থমকে যায় সে। হৃদপিন্ড টা কেমন ধড়াস ধড়াস করে লাফাচ্ছে। যেন আরেকটু সময় হলেই হৃদরহরণীর সামনে বেরিয়ে আসবে। বুকে হাত চেপে ধরে জোরে। ইশশশ একটু যদি হৃদস্পন্দন টাকে ধরে রাখা যায়। নাহ সম্ভব হচ্ছে না।
একপলক তাকাতেই আদর মাথা নিচু করে নেয়। ওই চোখ দুটোর মুগ্ধতায় যে সে কেঁপে কেঁপে উঠছে। হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে অন্য জগতে। হৃদানের চাহনী আদর কে আর সামনে এগোতে দিচ্ছে না। আদরের মনে হচ্ছে সে পড়ে যাবে। জোরে শ্বাস নিলো আদর। হৃদান মুচকি হাসলো; প্রেয়সীর মনের ভাব সে বুঝেছে কিন্তু চোখ সরালো না। কেন সরাবে? এতে যে তার অপরাধ হবে। চোখ দুটো তাকে অভিশাপ দিবে না?
আদর নিজেকে একটু ঠিক করে হৃদানের দিকে এগিয়ে গেল। হৃদানের দিকে তাকানোর সাহস আর হলো না। পিয়ানি আদর কে দেখেই চমকে দূরে সরে গেছে। তবুও চোখ যেন সরছে না। আদরের রূপের কাছে তার রূপ যেন কিছুই না। পান্চুকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আদর চোখ রাঙালো। পান্চু নিজের টাক মাথাতেই হাত দিয়ে বারি দিলো। এখন সব রাগ এসে তার উপর পড়বে। ভাবতেই মুখটা কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল। আদর গম্ভীর কন্ঠেই বলে উঠলো,
একজন অসুস্থ মানুষের সাথে কিভাবে ট্রিট করতে হয় জানেন না? দূরে সরে দাঁড়ান সবাই। বিয়ের শেষ পর্যন্ত কাউকেই যেন উনার আশেপাশে না দেখি। এনজয় করুন বিয়ে।
আদর কারোর দিকে না তাকিয়েই উপরে চলে যায়। একপ্রকার পালিয়েই যায় সে। আজ যেন হৃদানকে একটু বেশীই সুন্দর লাগছে। তার উপর চোখের চাহনী; মেরে ফেলার পায়তারা করছে লোকটা! হৃদান হাসে; একটু শব্দ করেই হাসে। আজ কেন জানি সবার সামনে একটু পাগলামি করতে ইচ্ছে করছে। চিৎকার করে ভালোবাসার জানান দিতে ইচ্ছে করছে। বুকের এই ধুকধুকানি টা সবার সামনে তুলে ধরতে ইচ্ছে করছে। তাই এবার নিজের আবেগ টাকে হৃদান কন্ট্রোল করতে পারলো না। চিৎকার করে বলে উঠলো,
ওহে হৃদয়হরণী!
থেমে যায় আদর। থমকে যায় সময়টা। হেলে পড়তে গিয়েও নিজেকে সামলে নেই সে। হৃদানের চিৎকার টা যতদূর শোনা গিয়েছে ততদূর মানুষ উৎসুক হয়ে তাকায়। হৃদানের দৃষ্টি অনুসরণ করেই আদর কে দেখতে পায়। যে এখন লেহেঙ্গা খামচে ধরে আছে। কেউ কথা বলছে না; দেখতে চায় পরে কি হয়! হৃদান আবার চিৎকার করে বলে,
ওহে হৃদয়হরণী! হৃদয়ের স্পন্দন! হৃদপিন্ডের কম্পন! আজ এত কেন পাগলামি করতে ইচ্ছে করছে? এত কেন কাছে পেতে ইচ্ছে করছে? এত আকুলতা কেন? এ কি করিলেন আপনি? আজ আমিটার যতটুকু নিজের ছিলো সম্পূর্ণ আজ হরণ করে নিলেন। কি আছে ওই চোখে! এত মাদকতা কেন?
আজ নিজেকে খুঁজে পাচ্ছি না; আপনি যে আমার সবটা কেড়ে নিয়েছেন। আপনার কম্পনরত ঠোঁটজোড়া যে আমাকে টানছে! ডাগর ডাগর চোখের বড় বড় পাপড়িগুলোর মধ্যে কালোর ন্যায় কাজলকে বড্ড হিংসে হচ্ছে। আমি কেন ওই চোখের কাজল হলাম না। আপনার ঠোঁটের রং গুলোকে বড্ড হিংসে হচ্ছে; আমি কেন বিচরণ করছি না আপনার ঠোঁটে।
আপনার বক্ষে কেন আমি নেই। লেহেঙ্গার আবরণ টা আমি কেন হলাম না। আপনার সাথে সম্পৃক্ত সকল কিছুকেই যে আমার হিংসে হয়। বুকের ভিতর চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হয়। একদম মিশিয়ে নিতে ইচ্ছে করে নিজের সাথে। ডুবে থাকতে ইচ্ছে করে আপনার চোখে। পাগল হয়ে যাবো আমি। পাগল হয়ে যাবো!
থরথর করে কেঁপে উঠে আদর। হৃদান যেন দূরে থেকেই আদরের কম্পন বুঝতে পারে। নেশাক্ত দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে। আদর এখনো চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে। হৃদানের দিকে ঘুরার সাহস তার হয়নি। চোখ দুটো অজান্তেই ছলছল করে। এই মানুষটা যে এত মানুষের মাঝে পাগলামি করলো তার কারণ টাও সে জানে।
এই আদর আহমেদ যে একমাত্র তার সেটাই প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লেগেছে। কিন্তু সুদর্শন পুরুষ টা কি জানে না তার মাদকতায় মেশানো কথাগুলো নেশার মতো কাজ করে। মাতাল হয়ে যায় সে। প্রেমে মাতাল হয়ে যায়। আর এই যে আপনি করে ডাকছে; এই আপনি ডাকটাই মে বার বার ঝড় বয়ে যায় মনে সে কি মানুষটা বুঝতে পারছে না? তবুও ইচ্ছে করে মানুষটা তাকে ভেঙে দিচ্ছে। একদম ভেঙেচুরে গুড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এবার যে সে ধরা দিবে না।
আদর দাঁড়ায় না, ছুট লাগায়। হৃদান মুচকি হেসে তাকিয়ে থাকে। সে জানে তার প্রেয়সীর মনোভাব। এও বুঝতে পারছে আর একটু পরেই থেমে যাবে আদর। ঠিক তাই হলো দু’সিড়ি উপরে গিয়েই থেমে যায়। সবার চোখ এখন আদরের উপরেই। তারাও দেখতে চায় আদর কি বলে। আদর ঘুরে দাঁড়ায়। ছলছল নয়নের রক্তিম মুখশ্রী চোখের সামনে ভেসে উঠতেই বুকে হাত দিয়ে চোখ বুজে নেয় হৃদান।
নাহ! আর পারা যাচ্ছে না। এই মেয়েটা নির্ঘাত তাকে মেরে ফেলবে। নুপুরের ঝুম শব্দে ফট করে চোখ খুলে হৃদান। আদর কাঁপা কাঁপা পায়ে নেমে আসছে। হৃদান নিজের অবস্থা আড়াল করে না; একদম পুরোপুরি ভাবে তুলে ধরে। হৃদানের চোখের দিকে তাকিয়ে আদর ঘোরের মধ্যে চলে যায়। নিজেও সমান তালে চিৎকার করে বলে উঠে,
ওহে বুকের পাশ! মস্তিষ্কের উদ্দীপনা! দেহের রক্ত সঞ্চালনের কারণ! নিঃশ্বাসের মাধ্যম! বিশ্বাসের স্তুপ! একটু পাগলামি করুন না! আরেকটু কাছে টেনে নিন। আকুলতার সহিত মাদকতা মেশানো বাণী গুলো শ্রবণ করতে যে মন টা বড্ড আনচান করে। আপনি সম্পূর্ণ টাই যে আমার। আদর আহমেদ নিজের সবকিছু একদম নিজের কাছেই রেখে দেয়।
আপনাকে খুঁজবেন না; এই আমাকে খুঁজুন পেয়ে যাবেন নিজেকে। সুদর্শন পুরুষটি কি জানে কাজল গুলো তার নামেই লিখা, ঠোঁটের উপরের আবরণ টা তো শুধু কৃত্রিমতায় ভরা; ঠোঁটের স্বচ্ছ হাসিটার মাধ্যম ই যে সে, বক্ষে না থাকলেও সে যে বক্ষের ভেতরে সবত্রই বিচরণ করে, উপরের আবরণ টা তো শুধু লোক দেখানো সে কি জানে মনের মধ্যে কতশত স্বপ্ন বুনে বসে আছি কবে রাঙাবো তাতে! আপনি পুরোটাই যে আমার। আপনার চোখেই মাদকতায় সিটিয়ে থাকতে চাই যে। বুকের বা পাশটাই সবত্রই বিচরণ করতে চাই। এই আদর আহমেদ সম্পূর্ণ টাই হৃদান চৌধুরীর।
আদর জোরে শ্বাস নিয়ে থামে। মনে হচ্ছে দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে। হৃদানের চোখে এক আকাশ সমান মুগ্ধতা, চোখের কোণে চিকচিক করছে আনন্দের অশ্রু। সবাই অপলক দেখছে দুজনকে। দুজনের মুখের একেকটা বুলিই প্রমাণ দিচ্ছে তাদের শুদ্ধতম ভালোবাসার। আদর আরেকটু এগিয়ে আসে। দু হাত মেলে দিয়ে বলে উঠে,
আদর তার হৃদ কে এত্তগুলা ভালোবাসে। আদর আহমেদ তার পৃদান চৌধুরী কে এত্তগুলা ভালোবাসে। আপনাকে ভালোবাসার কারণ আমার কাছে নেই আমি শুধু জানি আমার নিজের জন্যই আমি আপনাকে ভালোবাসি। ভালোবাসার মাত্রা টা এত বেড়েছে যে আমি নিজেকে খুঁজার আগেই আপনাকে খুঁজি। আপনি খুব খারাপ পৃদান চৌধুরী। খুব খারাপ।
নিঃশেষ করে দিলেন নিষ্ঠুর আদর আহমেদ। ভেঙে দিলেন বেপোরোয়া আদর আহমেদকে। এখন আদর আহমেদ একটা শিশুর ন্যায় হয়ে গেছে। একটু কিছু হলেই শক্ত চোখ দুটোতে তপ্ত জলেরা এসে ভর করে। এর জন্য আমি আপনাকে কখনো ক্ষমা করবো না পৃদান চৌধুরী। সারাটা জীবন আপনাকে আমার সাথে থাকতে হবে। এটাই আপনার শাস্তি!
চোখের কোণ ঘেসে একফোঁটা তপ্ত জল গড়িয়ে পড়লো। এতদিনের চাপিয়ে রাখা অনুভূতি গুলো আজ বের হয়ে গেছে। এতে সে প্রচন্ড খুশি। মনের মধ্যে চাপা আনন্দ অনুভব করছে। হৃদান নিজেও আজ শকড। এভাবে আদর সবার সামনে এতকিছু বলবে সে বুঝতেই পারেনি। স্বহাস্যে বলে উঠে,
এরকম শাস্তি পেতে আমি সবসময় রাজি। আপনাকে দেখার শাস্তির থেকে মধুর শাস্তি আর কিছু হতে পারে বলে মনে হয় না মিস আহমেদ। বুকের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখলেও যেন ভালোবাসার কমতি থেকে যায়। আপনার চোখের চাহনীই ছিলো হার্ট এ্যাটাকের কারণ এখন কি প্রেমময় কথা গুলো শুনে একেবারে মেরে ফেলার পায়তারা করেছেন নাকি! তাহলে যে আমি বার বার মরতে চাই! হাজার বার মরতে চাই!
খিলখিল করে হেসে উঠে আদর। হৃদানের রিয়েকশন গুলো যে এমনই ছিলো। তার খুব ইচ্ছে করে মানুষটার কপালে একটু ঠোঁটের স্পর্শ দিতে। কি যে হয়েছে তার! নিষিদ্ধ সব ইচ্ছেগুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠে মানুষটাকে দেখলে। আদর এক দৌড়ে হৃদানের সামনে দাঁড়ায়। মানুষটা এখনো একই ভাবে তাকে দেখছে। মনে হচ্ছে এ দেখার আর শেষ হবে না। একপলক সবার দিক তাকায় আদর। এখানে ছোটরা ছাড়া আর কেউ নেই।
বড় রা সব ভেতরের প্যান্ডেলে বসে আছে। হৃদানের দিকে খানিকটা ঝুকে নিঃশব্দে চুমু খেয়ে যে ছুট লাগায় আর পেছনে ফিরে তাকায় না। আদরের ঝুঁকে যাওয়া দেখেই মৃহান আতইয়াবের চোখ ঢেকে দেয়। এতক্ষণ মুগ্ধ হয়ে দেখছিলো সে। ব্যাপারটা বুঝে নিজেও মৃহানের চোখ ঢেকে দেয়। কথা হচ্ছে সে ভাই হলে মৃহান ভাসুর। তার ও দেখা অনুচিত। চার জনের এই মুহূর্তটা ক্যামেরা বন্দি করে নেয় ফটোগ্রাফার। এমন বিয়ে বাড়ি সে দেখেনি। প্রত্যেকটা স্টেপ ভিড়িও করে নিয়েছে। আর হৃদান তো এবার স্ট্যাচু হয়ে বসে আছে। এই মেয়েটার স্পর্শে কি আছে সে জানে না। তবে সে ঠিক নিতে পারে। বেসামাল হয়ে পড়ে, সারা শরীরে অসম্ভব কম্পন সৃষ্টি হয়। একসময় হৃদান টের পার তার গলা শুকিয়ে গেছে। চিৎকার করে বলে উঠে,
আধা টাকু পানি দাও গলা শুকিয়ে গেছে আমার!
কথাটা শোনা মাত্রই চারদিক হাসির শব্দে কলকল করে উঠলো কিন্তু একজন মানুষের মুখেই হাসি নেই। সে হলো কান্চু। চরম রেগে আছে সে। তার মিস ক্রাশু তাকে ছেড়ে অন্যকে কেন এসব বলবে। এই হৃদান চৌধুরী কে সে ছাড়বে না। পাদ মেরে উড়িয়েই দিবে আজ। জলদি পায়ে হৃদানের সামনে যেতেই কান্চুর সব রাগ হাওয়া হয়ে যায়। এই লোকটা কে সবাই ভয় পায় আর সে কিনা এই লোকটাকে কথা শোনাবে? জীবনেও পারবে না।
এখনি কেমন হাঁটু কাঁপছে। না পেরে কান্চু ঘাসের উপর বসেই ভ্যা ভ্যা করে কান্না করে দিলো। হৃদান সহ সবাই তাজ্জব হয়ে তাকিয়ে রইলো। কি হলো হঠাৎ? কান্চু কান্নার মধ্যেই ঠুসস করে পাদ মেরে সবার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হেসে দেয় কারণ তার পাদের শব্দে সবাই দূরে সরে গেছে। হৃদানের দিকে তাকিয়ে আবার কান্না; সবাই কেমন উৎসুক চোখে দেখছে। এমন বিয়ে বাড়ি তারা হয়তো আর দেখেনি। বেশ মজাও পাচ্ছে। কান্চু কেঁদে কেঁদেই বলে উঠলো,
তুমি আবার আমার মিস ক্রাশুর দিকে তাকাও। লজ্জা করে ছোট ভাইয়ের মতো ছেলের মিস ক্রাশুর দিকে তাকাতে। মিস ক্রাশু আমার। বড় হয়ে আমি বিয়ে করবো মিস ক্রাশু কে!
পান্চু কপাল চাপড়াচ্ছে। তার ভাই কে সবাই জোকার ভাবছে সে ভালোয় বুঝতে পারছে। হৃদান এবার চোখ রাঙিয়ে কান্চুর দিকে তাকালো। চোখের জল ছাড়া কান্না থেমে গেল কান্চুর । হৃদানের মনে হচ্ছে কান্চুকে শুট করে দিবে। এই ছেলে বলে আদর তার? আদর কে বিয়ে করবে? এটা শোনার আগে তার মরণ হলেও ভালো হতো। আদরের ক্ষেত্রে সে কোনো কম্প্রমাইস করবে না। আদর তার মানে স্রেফ তার! এবার কান্চু দাঁত কেলিয়ে হেসে যেই দৌড় দিতে যাবে তার আগেই হৃদান ধমকে বলে উঠে,
এই চুপ করে দাঁড়া। আদর তোর? বিয়ে করবি? এটা বলার জন্য তোর অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। যা হুইল চেয়ার ধর। আমি যেখানে যেখানে যাবো সেখানেই নিয়ে যাবি। একটা কথা বললেই শুট করে দিবো!
পান্চু হো হো করে হেসে দিলো। সে তো এই ছেলেকে কখনো জব্দ করতে পারবে না। তাকে ভয় ই পায় না। এবার হৃদানের হাতে পড়েছে ভেবেই আরেকদফা হাসলো। বেশীক্ষণ সেই হাসি স্থায়ী রইলো না, হৃদানের তীক্ষ্ম দৃষ্টি দেখেই থেমে যায়। ভয়ে ঢোক গিলে সে। হৃদান বলে উঠে,
আধা টাকু তোমার হাসি আর ভাই কে আগে না বুঝানোর জন্য শাস্তি হলো টাক মাথায় আধাঘন্টা বরফ দিয়ে রাখবে।
আমি যেদিকে যাবো সেদিকেই বরফ দিয়ে ঘুরবে।
পান্চুর ইচ্ছে করছে হাত পা ছড়িয়ে কান্না করতে। এর থেকে যদি টাক মাথায় একশোটা বারি দিতো তাও ভালো ছিলো। আধা টাকলা মাথায় আধা ঘন্টা বরফ দিলে সে আধা দিনও বেঁচে থাকতে পারবে না। কিন্তু সে বস কে ভয় পায়। করতেই হবে। হৃদান মনে মনে হেসে খুন হয়ে যাচ্ছে। এবার শুরু হলো শাস্তি। হুইল চেয়ারে বসে সে এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছে আর কান্চু বেঁচারা হৃদানকে নিয়ে ফেঁসে গেছে। হুইল চেয়ারে হলেও হৃদানের ভার কি কম?
তার মতো বাচ্চা একটা ছেলে কিভাবে সইবে। কি সুন্দর করে সেজেছিলো আদর কে ইমপ্রেস করবে বলে কিন্তু এখন তাকে কামলার থেকেও বাজে লাগছে। ঘামে চিপচিপ করছে শরীর; হৃদান নাকে রুমাল চেপে ধরে আছে কারণ কান্চুর পাদ তো ফ্রি আছেই। আর পান্চু তো যখনি বরফের পুটলাটা উপরে করে তখনি হৃদান চোখ রাঙিয়ে তাকায়। প্রায় দশ মিনিট পর হৃদান পান্চুকে ছাড়লেও কান্চুকে ছাড়েনা। বাহাদুর মুখে হাত চেপে হাসছে । সে জানে জোরে হাসলে তাকেও শাস্তি পেতে হবে।
অন্যদিকে আদর একটু পর পর ব্লাশ করছে। একটু আগে ঘোরের মধ্যে কি সব বলেছে তার উপর সবার সামনে চুমু! হাত দিয়ে মুখ ঢেকে নেয় আদর। হৃদযা সুবাহ মিটমিটিয়ে হাসছে। তারা ল্যাপটপে পুরো ঘটনা টাই দেখেছে। আদর এমনিতেও লজ্জা পাচ্ছে তাই আর লজ্জা দিলো না। আদরের হাত ধরে তিনজন বেরিয়ে গেল। প্রিয়জন ছেড়ে প্রিয়জনকে আঁকড়ে ধরার জন্য এগিয়ে যাচ্ছে দুজন। যত এগোচ্ছে ততই যেন খুশিটা বেড়ে যাচ্ছে তেমনি বুকটা ও ভার হয়ে যাচ্ছে। কি এক অনুভুতি! সুখকর ও যন্ত্রণাদায়ক দুটোই! তারা স্বইচ্ছেই এই অনুভূতি টা মাথা পেতে নিচ্ছে! সব মেয়েকেই যে নিতে হবে। পরের ঘরে যেতে হবে। নতুন এক সম্পর্কে নিজেদের বাঁধতে হবে! এটাই মেয়েদের জীবনের এক চরম সত্য!
রিসোর্টের গেটে দাঁড়িয়ে আছে সাফিন। চোখ তার লাল টকটকে। দেখেই মনে হচ্ছে ভেতরে ভেতরে সে শেষ হয়ে যাচ্ছে। এলোমেলো পায়ে ভেতরে ঢুকে। ভেবেছিলো তাকে ঢুকতে দিবে না কিন্তু চেইক না করেই ঢুকতে দিলো। সাফিন এতো কিছুর মাঝেও হাসলো। হৃদান চৌধুরী লোকটা বড্ড ভালো। কতটা বিশ্বাস করে নিয়েছে। মনের রানী কে দেখতে সেই সুদূর সিডনি থেকে এসেছে সে। এমন না হৃদযা কে সে বিয়ের সাজে দেখে নি।
মন পাথরে হঠাৎ ঝড় সিজন ২ পর্ব ১৪
দেখেছে ঠিকই কিন্তু ঠোঁটের হাসি টা দেখেনি। তাই তো ছুটে এসেছে। নিজের অপরাধের শাস্তি ভেবেই সে এসেছে। চারদিক একপলক তাকিয়ে একটা চেয়ারে বসে পড়ে। স্ট্রেজে বসা আতইয়াব-মৃহান স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কতটা খুশি আতইয়াব। বার বার সিঁড়ির দিকে তাকাচ্ছে। আবার হাসলো সাফিন। মাস্ক থাকায় কেউ দেখতে পেল না। নয়তো নির্ঘাত তাকে পাগল ভাবতো!